Wednesday, August 10, 2016

কোটা - মেধাবীদের স্বপ্নচুরি

কোটা -  মেধাবীদের স্বপ্নচুরি

কোটা পদ্ধতি কি ?

দেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা বিসিএস এর মাধ্যমে নারী ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যাতে সমান সুবিধা নিতে পারে এই লক্ষ্যে সরকার বিসিএসে উত্তীর্ণদের (প্রিলিমিনারী, লিখিত ও মৌখিক –তিনটিতেই উত্তীর্ণ) মধ্যে থেকে নারী, উপজাতী বা পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর অধিবাসীদের থেকে মোট ৫৫ শতাংশ প্রার্থীদের ‘কোটা পদ্ধতি’র ভিত্তিতে চাকরী প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাধিকার দেয় । এই ৫৫ শতাংশের সবচে বড় ৩০ শতাংশই রাখা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের নামে ।


কোটা পদ্ধতিঃ পাই ডায়াগ্রাম

পিএসসির পরীক্ষার ক্ষেত্রে এত দিন প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর চূড়ান্ত পর্যায়ে এই কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো । কিন্তু এবারের ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পর্যায় থেকেই এই কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে ।
পিএসসি এই বদ্ধতি ব্যবহারের জবাবদিহিতায় বলেছে, শেষ পর্যায়ে কোটা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কোটা পূরণ করার প্রার্থী পাওয়া যায় না, বছরের পর বছর পদ শূন্য থেকে যায় ।
পিএসসি’র ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারী চাকুরীতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশন পিএসসি । সেই সংস্কারেরই ফসল বর্তমানের নতুন কোটা পদ্ধতি ।

কোটা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য

• একটি বহুমাত্রিক সমীকরণ কাঠামো ।
• কোটার সাথে বিভিন্ন জেলা বা বিভাগের জন্য আরোপিত সংখ্যাগত সীমারেখা পদ্ধতিটিকে একটি জটিল রূপ দিয়েছে ।
• প্রার্থীদের বিভিন্ন ক্যাডারের চাকুরীর পছন্দক্রম বিবেচনায় এটির ফলপ্রসূতা অনিশ্চিত ।
• ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি একটি কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া ।

কোটা পদ্ধতির সমস্যা

এই কোটা পদ্ধতির সবচে বড় সমস্যা হচ্ছে মেধার অবমূল্যায়ন । লক্ষ্য করুন, পদ্ধতির কাঠামোটিকে দাড়িপাল্লার সাথে তুলনা করলে আয়ের চেয়ে দান-ক্ষয়রাতের পাল্লা বেশী ভারী হবে । মেধার ভিত্তিতে মাত্র ৪৫% যেখানে কোটার ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে ৫৫% কে !

সেটা আরো ভয়ংকর রূপ ধারন করেছে প্রিলিমিনারীর বাছাই প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই এর অপপ্রয়োগ থেকে । বিষয়টা কিছুটা এমন, আপনার কেরোসিন মজুদ করা আছে কিন্তু কেরোসিনের দাম ক্রমাগত কমছে । ঠিক তখন আপনি নিজের বাড়ি বানানো শুরু করলেন এবং শোবার ঘর ছাড়া কোন ঘরেই বৈদ্যুতিক বাতি লাগালেন না । আপনি কিছু হারিকেন কিনে এনে রান্নাঘরসহ বাকী চারটি ঘরকে আলোকিত করলেন । আলোকিত হয় নি এমন না । তবে আপনার বেশিরভাগ ঘরের কার্যক্ষমতাই কমে গেল । মজুদ করা কেরোসিন কাজে লাগাতে গিয়ে আপনি নিজের ঘরকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলেন না ।
বিগত দশ বছরের বিসিএস নিয়োগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মেধাতালিকায় ২০০-৩০০ এর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অনেক মেধাবী পরিক্ষার্থী ক্যাডার পান নি, যেখানে ২০০০, ৩০০০ বা তদূর্ধ্ব তালিকায় থেকেও শুধুমাত্র কোটার জোরে অনেক কম মেধাবীরা চাকুরি জুটিয়ে ফেলেছেন ।


২২০ তম হয়েও অনেকের বিসিএস জোটে না অথচ ৫৬৩২তম হয়েও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্য একজন এএসপি হয়ে যায় । বড়ই সেলুকাস ! বাবার যোগ্যতা কখনোই সন্তানের চাকরী পাওয়ার যোগ্যতার সার্টিফিকেট হতে পারে না । এতো আর ‘মেরী গো রাউন্ড’ এর রাইড না যে চার ফুটের নীচের বাচ্চাদের রাইড ফ্রি ।
হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কাছে ঋনী । স্বাধীন এ বাংলাদেশে তাদের পরিবারের প্রতিও আমাদের দায়বদ্ধতা আছে । নারী জাগরন, উপজাতী, অনগ্রসর এলাকা এদের প্রতিও আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে । কিন্তু, ৩০% বা ৫৫% ‘কোটা পদ্ধতি’ কোন ভাবেই আমাদের দায়বদ্ধতা পূরণ করার ক্ষেত্র হতে পারে না । সত্যিকার অর্থে, এই পদ্ধতি প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের অনুন্নয়নের ভাগীদার করে নেয়ারই একটি প্রক্রিয়া ।
একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা সবার আগে নিশ্চয়ই তার দেশকে ভালবাসবেন, তারপর পরিজনদের ।
সংবিধানের ২৯ (১) ও (২) অনুচ্ছেদ বলে,
১ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে
২ কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারনে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেইক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না ।
সংবিধানের ২৮ (৪) অনুচ্ছেদ বলে,
নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রনয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না ।
কাজেই ২৮ (৪) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাতারে ফেলে দিয়ে তাদের ৩০% কোটা প্রদান সংবিধানসম্মতও নয় । ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ২৩ তম বিশেষ বিসিএস অনুষ্ঠিত হয়েছিল । আবেগী দৃষ্টিকোণ থেকে এটাও মেনে নেয়া যায় । কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বংশের সকলের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত ৩০% কোটার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা, এ একরকম ‘আশ্চর্য’ !
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার । এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ০.২ % ও না । ৩৩তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অধিকাংশ পদই শূন্য আছে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে । মূলতঃ ঐ ধরনের পদগুলো কয়েক দশক ধরে শূন্যই পড়ে আছে । মুক্তিযোদ্ধা, নারী, উপজাতি ইত্যাদি কোটা ও পেশাগত ক্যাডারে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে ৮১০টি এবং ২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি পদ পূর্ণ করা সম্ভব হয় নি । এর সমাধান অবশ্যি আমাদের বিজ্ঞ ‘চিন্তক’গণ বের করেছেন । মন্ত্রনালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে কারিগরি ক্যাডারে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষি, মৎস্য ও শিক্ষা ক্যাডারে এক হাজার চারশ’ লোক নিয়োগ দেয়া হবে । মানে, আরেক দুর্নীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত !
আমরা কোটাভুক এই অংশটির জন্য সরকারী ঋণসহায়তা, বৃত্তি, বিনামূল্যে সর্বোচ্চ শিক্ষাসুবিধাসহ উত্তরাধিকার সুবিধা দিতে পারি । কিন্তু দেশের ক্ষতি করে, একটি মেধাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে এ কেমন কোটা পদ্ধতি ?
শুরুর দিকে বৈদ্যুতিক ও কেরোসিন বাতির উদাহরন দিয়েছিলাম । সেই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলার আছে । আপনার শোবার ঘরের বাতি চমৎকার কাজ করবে এমন গ্যারান্টিও নেই । যে ৪৫% প্রার্থী সরকার মেধার ভিত্তিতে নিল সেই ৪৫% এর মধ্যে আবার ঢুকবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এসব কারনেই বর্তমান কোটা পদ্ধতির জটিলতাকে স্বীকার করে নিয়েছে খোদ সরকারী কর্ম কমিশন, পিএসসি । পিএসসি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে কোটা সংক্রান্ত নতুন এই নীতিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

কোটা পদ্ধতি সম্পর্কে সুধিজনদের অভিমত

কোটাপদ্ধতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন,
“আমরা কোটা করার পরও মহিলারা পিছিয়ে আছেন । আমি তো মনে করি মহিলাদের জন্য কোটা আরো বৃদ্ধি করা উচিত। আর পার্বত্য অঞ্চলে যারা আছেন গারো, মারমা, ত্রিপুরা অন্যান্য যারা আছেন এদেরকেও তো উঠিয়ে আনতে হবে। এটাতো অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। অন্যান্য দেশেও আছে। সবই যদি মেধার ভিত্তিতে হয় তাহলে পিছিয়ে যারা, অবহেলিত যারা আছেন তারাতো কোনদিনই আসতে পারবেন না। জনগণের মধ্যে যে একটা বৈষম্য, যেটা আগে ছিল সে বৈষম্যটা দূর করাই সরকারের উদ্দেশ্য। সাম্য নয় সমতামূলক কোন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য এটা রাখা হয়েছে। আমি কোটার সম্পূর্ণ পক্ষে।”
প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা কোটা প্রথাকে পূর্ণ সমর্থন করলেও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ আকবর আলি খান ২০০৮ সালের একটি গবেষণায় ৫৫% কোটাকে অমানবিক উল্লেখ করে এর যৌক্তিকীকরণের কথা বলেন । তিনি স্পষ্টভাবে বলেন,
The recruitment under quota must not be higher than that of merit.
তিনি আরও বলেনঃ
“It gives people an impression that less efficient people get appointments through the quota system and thus the quality of public administration drops.”
মানবজমিন পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে পিএসসি’র চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী বলেন,
বর্তমানে প্রচলিত কোটা প্রয়োগ পদ্ধতি সরলীকরন করা প্রয়োজন ।
পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এস এম ফায়েজ বলেন,
সরকারী চাকুরীতে মেধাকে সবচে গুরুত্ব দেয়া উচিত । কেননা, মেধাবীরাই একসময় দেশের নেতৃত্ব দেবে । মেধাবীরা সরকারী চাকুরীতে আসলে গতিশীল নেতৃত্ব তৈরী হবে । যেভাবেই হোক না কেন, মেধার কোন বিকল্প নেই । মেধাকে যত প্রাধান্য দেয়া হবে তত বেশী আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,
এদেশে এক ধরনের গোষ্ঠী আছে যারা চায় যে সরকারী নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে কোটা থাকুক । আমি মনে করি না যে সব ধরনের কোটা এখন দরকার আছে । কিছু কোটা থাকবে কিন্তু সেসব কোটার সময় উল্লেখ করা যেতে পারে যে তা কত বছর বহাল থাকবে ।
ড আকবর আলি খানের রিপোর্টেও permanently or for an indefinite period কথাটি জোরালো ভাবে এসেছে ।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনদের প্রায় সকলেই একটি বিষয়ে একমত । সেটি হচ্ছে, স্বল্প সময়ে নির্ভুল একটি বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রম তথা নন-ক্যাডার সহ ১ম ও ২য় শ্রেনীর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল সুচারূ ও গ্রহনযোগ্য রূপে বাস্তবায়নের স্বার্থেই কোটা পদ্ধতির সরলীকরন আবশ্যক ।

কোটা পদ্ধতির ক্ষেত্রে সরকারী নীতিমালা কি হওয়া উচিত ?

প্রফেসর মুজাফফর আলির নেতৃত্বে ২০০৭ সালের টিআইবি’র প্রতিবেদনে কোটা পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে,
The quota system is implemented without transparency.
একথা বলার প্রধান কারন, পিএসসি থেকে কখনো কোটা পদ্ধতিতে নির্বাচিতদের সুস্পষ্ট তালিকা এবং কি নীতিতে তাদের সরকারী চাকুরীর জন্য বাছাই করা হয়েছে এবং মন্ত্রনালয় থেকে তাদের জন্য সুপারিশের সুনির্দিষ্ট কারন আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি । সরকারী নথিপত্র বা গেজেটে বিসিএস পরীক্ষায় কোটা বিষয়ক কোন সুনির্ধারিত ও স্পষ্ট ধারনা দেয়া নেই ।
রিপোর্টটি কোটা সমস্যা সমাধানের জন্য দুটি প্রস্তাব রাখেঃ
1. The existing quota system for freedom fighters and district are no longer considered logical and should be abolished.
2. At least 75% of places should be on purely merit basis, while the remaining may be distributed for affirmative action on the basis of gender, ethnic and religious identity.

শুধু কি কোটা সিস্টেমের সমস্যা ? কেঁচো খুড়তে সাপ

কোটা পদ্ধতি কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্র ?
এটি কি সত্যিকার অর্থেই নারী, উপজাতী ও অনগ্রসর জেলাগুলির উন্নয়নের স্বার্থে ?
টিআইবি’র ২০০৭ সালের রিপোর্টের নীরিখে আসুন, আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করি । রিপোর্টের নবম পৃষ্ঠায় ‘Irregularities in BCS examination’ শিরোনামে কঠিন ভাষায় যেসব কথা লেখা আছে তা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক ।
১. ঘুষের লেনদেন ও চুক্তিভিত্তিক ‘মেধা’ নির্বাচন নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না বলে ক্রমেই বর্ধিষ্ণুতার হার বাড়ছে । উদাহরনস্বরূপ জরিপে দেখানো হয়েছেঃ
ক। মেরিট লিস্টে থাকা প্রার্থীদের পছন্দসই ক্যাডার প্রদানে যেসব চুক্তি করা হয় তার অর্থের পরিমাণঃ
• প্রশাসন / পুলিশ ক্যাডার – ৳ ৫-৭ লাখ
• কাস্টমস্‌ / ট্যাক্স – ৳ ৮-১০ লাখ
• প্রফেশনাল ক্যাডার – ৳ ২-৩ লাখ
খ। মেরিট লিস্টে না থাকা প্রার্থীদের পছন্দসই ক্যাডার প্রদানে যেসব চুক্তি করা হয় তার অর্থের পরিমাণঃ
• প্রশাসন / পুলিশ ক্যাডার – ৳ ৮-১০ লাখ
• কাস্টমস্‌ / ট্যাক্স – ৳ ১০-১২ লাখ
• প্রফেশনাল ক্যাডার – ৳ ৩-৫ লাখ
২. ২৪তম বিসিএস থেকে প্রায় প্রতিবার ক্রমাগত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পাওয়া গেছে । ৩৩তম বিসিএসের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারনে ।
৩. পরীক্ষার হলে সিট নির্ধারণও ঘুষের বিনিময়ে করা হয়ে থাকে ।
৪. পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত প্রার্থীকে উপস্থিত দেখিয়ে উত্তরপত্র দেয়া হয় এবং চুক্তির মাধ্যমে পরে উত্তরপত্র বদলানোর সুযোগ থাকে ।
৫. মেরিট লিস্ট ও ফলাফল নির্ধারনেও দুর্নীতির ঢালাও ব্যবস্থা । এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে ঘুষ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে ।
৬. ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষায় পূর্বে করা অর্থচুক্তির মাধ্যমে প্রার্থীর অধিক নম্বর আদায় করার সুযোগ আছে ।
৭. মৌখিক পরীক্ষায় ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ প্রশ্ন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে । যেমন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে ?
৮. ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রায় প্রতিবারই প্রার্থীদের চাকরিদান করা হয়েছে ।

৯. প্রার্থীর সাথে নেগোসিয়েশনের জন্য পিএসসি সদস্যরা প্রার্থীদের কমিশনে তলব পর্যন্ত করে ।
১০. ২০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকেই পিএসসি থেকে ভুয়া সার্টিফিকেটধারীদেরকে সুবিধা প্রদান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ।
১১. বিসিএস পরীক্ষার যাবতীয় নথি কোনরকম পদ্ধতি অনুসরন না করেই নষ্ট করে ফেলা হয় ( সেক্রেটারিয়েট রেগুলেশন ১৯৭৪ ) ।
এবং সবচে বড় কথা, পিএসসি নির্দিষ্ট কোন কোঠায় কোন প্রার্থী চাকুরীপ্রাপ্ত হয়েছে এই বিষয়ক কোন ধরনের নথিপত্র আজ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি ।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করেনি ? এবং কাদের স্বার্থে ?
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রতি সহানুভূতির স্বার্থে, নারী জাগরনের স্বার্থে, বৈষম্য দূরীকরনের স্বার্থে ?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর না লেখাই সঙ্গত বোধ করছি । কারন, কিছু কিছু প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে থাকে । বাগধারায় এগুলিকে বলা হয় ‘Open Secret’ ।

সাধারন দাবি

কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবীতে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে । যদিও এসব আন্দোলন শিব গড়তে বাঁদর গড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি । সংস্কারের বদলে বারবার পদ্ধতিতে যোগ হয়েছে আরও নতুন সব শর্ত ।
সাংবাদিক শরিফুল হাসান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন,
পিএসসি’র নিউজ করতে না গেলে আসলে আমি জানতামই না এই দেশে সরকারী চাকুরী প্রার্থী ছেলে-মেয়েদের কি ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হয় । ৮০ পেয়েও কেউ চান্স পাবে না আবার কেউ ৫০ পেয়ে চান্স পাবে, এইটা কোন সভ্য দেশের নিয়ম হতে পারে না ।
ইন্টারনেটভিত্তিক একটি পত্রিকা পড়ে কিছু শিক্ষার্থী মন্তব্য জানলাম । একই সুর তাদের গলাতেও । হাসনা হাসি নামের এক নারী শিক্ষার্থীর কথা তো রীতিমতো চমকে দেয় । তিনি বলেন,
আমি স্বেচ্ছায় আমার নারী কোটা ত্যাগ করলাম । কোন ছেলের থেকে শিক্ষা, যোগ্যতা এবং পরিশ্রমে আমি কোন অংশে পিছিয়ে নেই । তাই ‘নারী’ নামের কোটা থেকে মুক্তি চাই ।
সত্যিই তো ! যেখানে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় মন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদ স্পীকারসহ বড় বড় পদ গুলোকে নারীরা অধিকার করে নিতে পেরেছে, সেখানে এদেশে নারীরা আজও পিছিয়ে আছে এমন ভাবাটাই তো ভুল । তবু কিছু অনগ্রসর নারী এখনও আছে, একথা অবশ্য স্বীকার্য । কিন্তু তাদের জন্য অবশ্যই এই ১০% কোটা নয় !

বর্তমান পরিস্থিতি

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিসিএস পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি, ৩৪তম প্রিলিমিনারী পরীক্ষার ফলাফল বাতিল ও পুনর্মূল্যায়নের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সিলেটে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে । তাদের প্ল্যাকার্ডের শ্লোগানগুলি ছিলঃ
কোটা মেধাবীদের সুইসাইড স্কোয়াড
কোটা অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই
দাবি শুধু একটাই, কোটামুক্ত দেশ চাই
ঢাকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেনীর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে । তারা শাহবাগ এলাকা অবরোধ করে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তোলে । ১০ জুলাই এ শিক্ষার্থীরা দিনভর সড়ক অবরোধ করলে পিএসসি ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারির ফল পুন:বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয় । কিন্তু পিএসসির সিদ্ধান্ত জানার পর ‘বঞ্চিত’ শিক্ষার্থী ব্যানারে এ আন্দোলনকারীরা কোটা পদ্ধতি বাতিলকে তাদের প্রধান দাবি হিসেবে তুলে ধরে আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেয় । দাবি আদায়ে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত তারা শাহবাগ অবরোধ করে অবস্থান করে ।
এর পর শাহবাগে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে গতকাল বুধবার বিকালে সদ্য প্রকাশিত ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল পুন:বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) । গণদাবীর মুখে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ৩৪তম বিসিএসের প্রাথমিক পরীক্ষার ফল পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছে ।

পাঁচ দফা দাবী ও তার যৌক্তিকতা

পিএসসি’র শুধুমাত্র পরীক্ষার ফল পুন:বিবেচনার সিদ্ধান্তকে আন্দোলনকারীরা সাধুবাদ জানাতে পারে নি । তারা সরকারের পদক্ষেপের আশায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । তারা তাদের পাঁচটি দফা নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে । কিছু কিছু দাবী অবশ্যই যুক্তিযুক্ত । যেমনঃ
ক জেলাভিত্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল
খ মুক্তিযোদ্ধা কোটা শতকরা দশ ভাগ
গ মোট হিসেবে যাবতীয় সকল কোটা শতকরা ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে
আন্দোলনকারীদের অনেকে আবার বলছেন, পিএসসি ফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলেও চাকরিতে বিদ্যমান সব ধরনের কোটা ও ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল বাতিল না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে ।

সরকারের অবস্থান

১১ জুলাই । রমজান মাস চলছে । এরই মধ্যে কোটা প্রথা তুলে দেয়ার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থানরত বিসিএস শিক্ষার্থীদের ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং পুলিশের দফায় দফায় টিয়ারশেল নিক্ষেপ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় ঐ এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হল । শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা এবং দফায় দফায় টিয়ারসেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিলে শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া । শিক্ষার্থীরা ঢাবির ভিসির ভবনে হামলা করে । ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা কেন, জবাব চাই’ এই স্লোগানে চারপাশের বাতাস উষ্ণ হয়ে ওঠে ।
শুরুটা মূলতঃ সকাল ১১টায় । আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান শুরু করলে পুলিশ লাঠি শুরু করে । এক সময় পুলিশ টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে । এ সময় পুলিশ কয়েক দফায় ১০ থেকে ১৫ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে । এ সময় শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় থেকে চারুকলায় অবস্থান নেয় ।
শিক্ষার্থীরা পিছু হটলেও পুলিশের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে । এক সময় শিক্ষার্থীরা চারুকলার সামনের ভাস্কর্যতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীরা বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি যানবাহণ ভাংচুর করে । এ ঘটনায় বহু শিক্ষার্থী আহতও হয়েছে ।

পুলিশ থেমে থেমে টিয়ারসেল ছুড়ছে । কাঁদানের গ্যাসের শেল ছুঁড়ছে । চারদিক কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার আচ্ছন্ন । জলকামানসহ ফোর্স জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে । এরই মধ্যে শুরু হয় ছাত্রলীগের হামলা । মধ্যাহ্নে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মাস্টার দা সূর্যসেন হল থেকে আসা ছাত্রলীগের বেশকিছু নেতা-কর্মী । তাঁরা পরীক্ষার্থীদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় । কোটা রাখার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে থেকে ছাত্রলীগ একটি মিছিলও বের করে । হায়রে বাংলাদেশ !

সরকারের অবস্থান জানতে এতোটুকু সংবাদপাঠই যথেষ্ট । দেশের ১০ লাখ ‘মেধাবী’ তরুনকে সরকার প্রত্যক্ষভাবে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিল । এরা শুধু এই সরকারকে ভোট দেবে না, তা নয় । নিজেদের মেধাকে এরা আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে কাজেও লাগাবে । এমনিতেই ৫ সিটি কর্পোরেশনে হারের পর বর্তমানে দলটির রাজনৈতিক অবস্থান বেশ নাজুক । এই অপ্রয়োজনীয় কঠোর বৈপরীত্যের অবস্থান কি সরকারের জন্য আদৌ কোন সুফল বয়ে আনতে পারবে ?

কিছু ষড়যন্ত্র ও সরকারের চোখ

গতকাল ফেসবুকে দেখলাম, সাহিত্যচর্চা করে সাহিত্য বোঝে এমন একজন বেশ দম্ভ ভরে লিখলেনঃ
হুঁশিয়ার মামু আর মামীরা,ছাগু-হাগুর তালে নাইচা ফাইসা যাইয়ো না,তোমারা যেমন ভিত্তিহীন কোটা বাতিলের আন্দোলন করতে পার আমরাও তেমন কোটা রক্ষার আন্দোলন শুরু করতে পারি।ভাল থাকতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কটাক্ষের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে লাইনে আস,আমারা যদি আন্দোলনে নামি তাইলে কিন্তু খবর আছে ।
পড়ে আমি হতভম্ভ । রাজনীতি জিনিসটা আসলেই সুবিধার না । এটি ‘শয়তান’ এর রূপক নাম বিশেষ । এই কীট অজান্তেই শিরা-উপশিরায় মিশে রক্তকে নিমেষেই দূষিত করে দিতে পারে ।
শাহবাগে এই সরকারের এই দুঃখজনক অবস্থানের পর এইচ টি ইমাম বলল,
৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি ফল বাতিলের দাবীতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে সেটা নিয়ে যেন কোন ধরনের অস্থির পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ কেউ না নিতে পারে, সে কারণেই এ ফল পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন ।
কষ্ট করে আবার শুরুর থেকে ভাবতে বসতে হয়, সরকারের চোখ আসলে কোথায় ?

শেষ কথা

বিসিএস পরীক্ষা প্রথম শ্রেনীর গেজেটেড কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষা পদ্ধতি । এই পরীক্ষায় মেধার অবমূল্যায়ন কখনোই কাম্য নয় । দেশের স্বার্থে, সর্বোচ্চ এ প্রক্রিয়াটির পদ্ধতিগত সমীকরণ তৈরীর ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভুল হওয়া উচিত নয় । স্বাধীনতার ৪০ বছর পার হয়ে গেছে । সময় এসেছে পরিবর্তনের । দেশ-জাতি-আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা-রাষ্ট্র ব্যবস্থা সব কিছুকেই পরিবর্তিত করবে এইসব মেধাবীরা । তাই ‘মেধাবী’ নির্বাচনে কোন আপোষ কি সত্যি করা উচিত ? আশু পরিবর্তন কি কাম্য নয় ?

No comments:

Post a Comment